আজ থেকে বহু বছর আগের কথা। আমি তখন কলেজে পড়ি। একদিন কলেজ থেকে ফিরে দুপুরে খেয়ে দেয়ে ড্রয়িং রুমে টিভি দেখছি এমন সময় কেউ কলিং বেল চাপল। খুলে দেখি এক গরিব মহিলা সাথে দুটা ছোট বাচ্চা। করুন স্বরে অনুনয় করে বলল দুগগা ভাত হইব? এই সময়ে ভাত? আমাদের সবার খাওয়া শেষ। আমি বাদে সবাই ঘরে দিবা নিদ্রা যাচ্ছে। বললাম আচছা দেখি। ফ্রিজ খুলে দেখি সামান্য অল্প কিছু ভাত ছিল।সাথে ঠান্ডা হয়ে যাউয়া অল্প কিছু তরকারি আর ডাল। তাই এনে দিলাম।সেই মহিলা তার বাচ্চাদের নিয়ে অই টুকুনি ভাত খুব তৃপ্তির সাথে খেলেন তার বাচ্চাদেরো খাওয়ালেন চোখে পানি চলে এল। ওদের বলে দিয়েছিলাম যখন ক্ষিদে পাবে চলে আসতে।আর আসেনি।সেই মহিলার আনন্দ আর কৃতজ্ঞ মাখা চোখের দৃস্টি ভোলার মত নয়।। সেদিন আমার উপলব্ধি হল পৃথিবির সবচেয়ে বড় কস্ট হল ভাতের কস্ট। এই কস্টের সাথে অন্য কোন কস্টের তুলনা হয়না। আমার স্ত্রি যখন সাংসারিক এটা অটা নিয়ে অভিযোগ করে মন খারাপ করে তাকে কেবল একটা কথাই বলি ভাতের কস্ট তো আমাদের আল্লাহ দেন নি।
মনে পড়ে বিয়াল্লিশ সালের দুর্ভিক্ষের কথা।তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। বৃটিশ সরকার তার সৈন্যদের রসদ জোগাবার জন্যে বাজার থেকে চাল কিনে মজুত করে রেখেছে বাংলা থেকে বহু দূরে পাঞ্জাবের গুদামে। আবার জাপানি সেনা আক্রমনের ভয়ে সমস্ত নৌযান গুলো আটক করে রেখেছে। ফলে বাংলায় নেমে এল দুর্ভিক্ষ।এর ই নাম পঞ্চাশের মন্বন্তর। এই দুর্ভিক্ষ কিন্তু ফসলের অজন্মার জন্যে হয়নি। হয়েছিল কিছু মানুষের লোভের কারনে। মানুষ ভাতের অভাবে কচু ঘেচু শাক পাতা খেয়ে বাচার চেস্টা করেছে।বাংলার মোট জন সংখ্যার একটা বড় অংশ যারা দারিদ্র্য সীমার নীচে বাস করত তারা মারা যায়। ক্ষুধার অন্ন জোটাতে দলে দলে লোক গ্রাম থেকে ছুটে আসে শহরে। এ দেখেই বিভুতি ভুষন লেখেন তার বিখ্যাত উপন্যাস অশনি সংকেত যা পরবর্তী তে চলচ্চিত্রায়িত হয় সত্যজিত রায়ের মাধ্যমে। ডাস্টবিনে মানুষে কুকুরে খাবার নিয়ে কাড়া কাড়ি। এই দেখে কলকাতা আর্ট কলেজের এক ছাত্র স্কেচ করেন কিছু ছবি যা তাকে স্মরনিয় করে রাখে। তিনি শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন। ময়মন্সিংহের জয়নুল আর্ট গ্যালারিতে আছে সেই ছবি গুলো। সেই সময়ে তখন ভাত এত দুস্প্রাপ্য ছিল যে তখন কোলকাতায় ভিখিরি রা বলত মাগো ভাত চাইনা এট্টু ফেন থাকলে দাও গো (অর্ধেক জীবন; সুনীল গংগোপাধ্যায়)
বংগবন্ধুর ৭ মার্চের অনল বর্ষি বজ্রকন্ঠি ভাষন- সেখানেও আছে ভাত
তোদের ভাতে মারব
পানিতে মারব
মাওলানা ভাসানির বক্তৃতাতেও আছে ভাত।
বলেছিলেন
ভোটের আগে ভাত চাই
নইলে ব্যালট বাক্সে লাথি মার
কবিতা তে ও এসেছে ভাত
রফিক আজাদের সেই বিখ্যাত কবিতা
ভাত দে হারামজাদা
নইলে মানচিত্র খাবো।
এটি লেখার পর উনার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হইছিল।
হুমায়ূন আহমেদ লিখে গেছেন
পৃথিবীতে সব চাইতে কঠিন রান্না হল
ঝরঝরে ভাত রান্না করা।
সত্তরের দশকে অসাধারণ একটা সিনেমার নাম ভাত দে।যেখানে অভিনয় করে শাবানা পেয়েছিলেন সারা দেশে অনন্য খ্যাতি। এই সিনেমা দেখে চোখের পানি ফেলেন নি এমন দর্শক বিরল বাংলায় স্বামীর এক নাম ভাতার শব্দ টা এসেছে সংস্কৃত ভতৃহারি থেকে অর্থাৎ যে কিনা ভাতের সংস্থান করবে।মানে যিনি বিয়ে করবেন তিনি তার স্ত্রীর ভাতের ব্যবস্থা করবেন। এ জন্যেই বাংলায় এই প্রবাদ প্রচলিত
ভাত দেওনের মুরোদ নাই
কিল মারার গোসাই
ভাত খুবি গুরুত্বপুর্ন বাংগালির জীবনে।আজকাল অনেকে ডায়বেটিসের ভয়ে রুটি খাচ্ছেন কিন্তু তাতে যেন প্রানের ক্ষুধা মেটেনা।প্রায় ই রুগিরা অভিযোগ করে পেট নাকি ভরেনা। শায়েস্তা খার জামানায় নাকি টাকায় আটমন চাল পাওয়া যেত।কিন্তু বাস্তবতা তখন এটা কেনার মত সামর্থবান লোক ছিলনা। আমাদের বলা হয় মাছে ভাতে বাংগালি। বলা হয় চাল উতপাদনে আমরা স্বয়ং সম্পুর্ন হয়ে গেছি। মাছ উতপাদনে নাকি বিশ্বে চতুর্থ। শুনতে ভালই লাগে। গর্বে বুক ফুলে যায়। ইশ বাজারে গিয়ে যদি এর মিল পাওয়া যেত। নিম্ন মানের মোটা চাল ও ৬০ টাকার কম নয়।গরীব লোক গুলো কি খেয়ে বাচবে?
এবার বলি এক মায়ের গল্প। তখন ১৯৭১ সাল। দেশে চলছে মুক্তিযুদ্ধ।আজাদ নামের এক তরুন সে ও গেলো মুক্তিযুদ্ধে। ধরা পড়ে গেল পাকিস্তান আর্মির কাছে। তাকে খুব অত্যাচার করছে তার সাথী দের নাম বলার জন্যে।কিন্তু আজাদের মা বলে দিয়েছেন তার ছেলে কে বাবারে যতই তরে মারুক তুই কারো নাম বলিস না।মা গেছেন আর্মি ক্যাম্পে ছেলের সাথে দেখা করতে।ছেলে মা কে বলল মা ওরা খুব মারে।মা বলে দিলেন তুই নাম বলিস না বাবা। ছেলে ভাত খেতে চেয়েছিল। মা ছেলের জন্যে ভাত রান্না করে নিয়ে এলেন ক্যাম্পে। ততক্ষণে আজাদ কে আর্মি রা মেরে ফেলেছে। সেই মা এরপর যতদিন বেচে ছিলেন ভাত মুখে নেন নি। আনিসুল হক এই আজাদ এবং তার মায়ের আত্মত্যাগ কে নিয়েই লিখেছেন তার বিখ্যাত উপন্যাস মা। আমাদের গর্ব এই আজাদ নামের মুক্তিযোদ্ধা কে নিয়ে যে শত অত্যাচারেও মায়ের কথায় তার সাথীদের নাম বলে দেয়নি এরকম হাজারো লক্ষ আজাদের মায়ের আত্মত্যাগে এসেছে আমাদের আজাদী। সেই স্বাধীন দেশে কৃষক ধান উৎপাদন করে এর ন্যায্য মূল্য পাওয়া থেকে বঞ্চিত। সেই বাংলায় আজ গরীবের মোটা চালের কেজি ৬০ টাকা। জাতির কাছে এর চাইতে লজ্জার আর কি হতে পারে বলুন।