• আজ- মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:০৩ পূর্বাহ্ন

বাংলা ভাষা চর্চা, বর্তমান প্রজন্ম এবং নিজস্ব ভাবনা

লেখক : / ১৮৩ বার দেখা হয়েছে
আপডেট : বুধবার, ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

add 1
  • ড. আবু ইউসুফ মো. আব্দুল্লাহ

লেখক: প্রফেসর, আইবিএ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসিডেন্ট, নর্দান এডুকেশন গ্রুপ।

৫২-এর ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই এদেশের স্বাধীনতা ও স্বাধিকারের আন্দোলন অগ্নিরুপ ধারণ করে তা মুক্তিযুদ্ধতে পরিণত হয়েছিল, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছিল। ৪৭-এর দেশভাগের সময় বাংলাকে ভাগ করে দেয়া হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরাকে ভাতের সঙ্গে রেখে শুধু পূর্ব বাংলাকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। এই পূর্ব বাংলা পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক তেইশ বছর ভয়াবহ দুঃশাসনের শিকার হয়েছে। আমাদের ভাষার অধিকার হরণের নিলজ্জ চেষ্টা করা হয়েছে। আমাদের শিল্প-সাহিত্যের ওপর আগ্রাসন চালানো হয়েছে। আমাদের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির ওপর বহুবার বহুভাবে বহুকৌণিক রাজনৈতিক আঘাত এসেছে। কিন্তু এদেশের মানুষ তার নিজের ভাষা-শিল্প সাহিত্যে কখনো কোনো আপস করেনি। নিজের অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলেনি। সমস্ত জাতধর্মের চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে- বাঙালির বাঙালিত্ব। এটি আমাদের প্রাণের মূল শক্তি। যত সংকট আসু- যত সমস্যা আসুক বাঙালির শক্তি তার ৫২-এর ভাষা আন্দোলনের চেতনা। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষিত কি? এ প্রশ্ন খুব স্বাভাবিক। আমরা কি আগের চেতনায় অটুট আছি নাকি অন্য ভাষা-শিল্প-সাহিত্যে পরনির্ভরশীল হয়ে যাচ্ছি? এ বিষয়টি বোধ হয় এখন খুব করে ভাভার বিষয়। মাতৃভাষার মর্যাদার জন্য যে দেশের সন্তানেরা বুকের তাজা রক্ত দিয়েছে, যে রক্তের স্রোতে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে-স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ অর্জিত হয়েছে-সেই দেশের মাতৃভাষা ভয়াবহ এক অশনি সংকেত বহন করছে বলেই অনুভূত হচ্ছে। এ ধারণাকে অমুলক ভেবে উড়িয়ে দেয়ার সুযোগ বোধ হয় বর্তমানে নেই বরং গুরুত্বের সঙ্গে এটাকে বিবেচনা করা জরুরি হয়ে পড়েছে। বর্তমান প্রজন্ম চরম এক অবক্ষয়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। বর্তমান প্রজন্মে অনেকেই জানে না একুশে ফেব্র“য়ারি কেন আমরা শ্রদ্ধা-সম্মানে স্মরণ করি কিংবা জাতীয় জীবনে এ দিনটির বিশেষ গুরুত্ব কেন! এ দিনটি বাঙালির জীবনে কেন অতি তাৎপর্যময়! একই ভাবে তারা জানে না স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবস কি! এসব দিন বাঙালির জীবনে কেন অবিচ্ছেদ্যতায় যুক্ত। জানে না এসব দিনের ইতিহাস। বাংলা ও বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসের প্রতিও তাদের কোনো আগ্রহ নেই। এ প্রজন্ম যে অবক্ষয়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, তাতে তাদের মুল্যবোধ নীতি-নৈতিকতা দেশপ্রেম এসব শেকড়হীন হয়ে পড়ছে। নিজের দেশে তারা নিজেদের ভবিষ্যৎ তৈরির কথা ভাবছে না। ফলে বিদেশে নিজেদের ভবিষ্যৎ তৈরির জন্য যা যা করণীয় তা করছে। সেই করণীয়গুলোর মধ্যে নিজের দেশ নিজের নিজের ইতিহাস-ঐতিহ্য সব কিছু উপেক্ষিত হচ্ছে। বিদেশি ভাষা ও সংস্কৃতি তাদেরও কাছে অদিক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বলা যায় সেসবের প্রতি তারা মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। এতে করে তাদের মধ্যে দেশের প্রতি, দেশের ভাষার প্রতি কোনো দায়বোধ তৈরি হচ্ছে না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও সেক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে ইে অবক্ষয় থেকে তরুণ প্রজন্মকে বের করে আনতে পারতো তা বোধ হয় করতে পারছে না, বা সেভাবে চেষ্টা নেই, আগ্রহ নেই। বর্তমানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যখন পূজিবিকাশই আসল, তখন আদর্শ ও চেতনা থাকে কোথায়। ভাষা আন্দোলনের চেতনা কে ধারণ করে! যে বিষয়ে লেখাপড়া করে ভালো ছাকরি হয় না, চাকরির বাজারের গুরুত্ব কম, সেই বিষয়ে পড়ালেখা করার যৌক্তিকতা কোথায়-সেসব বিষয় বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু করা মানে প্রতিষ্ঠানের অর্থনৈতিক ক্ষতি এটা যখন হিসেবের বিষয়, তখন অবক্ষয় তো অবধারিতভাবে অক্টোপাসের মতো আঁকড়ে ধরবে এটাই স্বাভাবিক। বাস্তবে হচ্ছেও তাই। অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগ চালূ করার ক্ষেত্রে অনীহা। অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ নেই। অথচ ভাষার মাসে দরদে ষোল আনা উপচে পড়ে তাদের কণ্ঠে-অবহেলায় টানানো দায়সারা গোছের ব্যানারে। অথচ সেখানে চেতনার অগ্নিস্পর্শে জ্বলে ওঠার কথা আমাদের, সেখানে আমরা মূলচেতনা থেকে সরে যাচ্ছি। ৫২-এর ভাষা আন্দোলন নিয়ে আমরা অনেক আদর্শের কথা বলি। সেই আন্দোলনের চেতনাতেই ৭৪-এর মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জন। ভাষা শহিদ রফিক বরকতের নামে আমরা একদিন প্রভাতভেরি করি, আলোচনা অনুষ্ঠান কতো কী করি। শুধু ঐ একদিনই। বাংলা শুধু ঐ একদিনের জন্যেই। একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ যে দেশের ভাষা বাংলা, যে ভাষার জন্যে বুকের তাজা রক্ত ঢাতে হলো রাজপথে যে রক্তের স্রোতে অর্জিত হলো স্বাধীনতা সেই ভাষা অবহেলিত। মানুষের মুখে অবজ্ঞায় উচ্চারিত হয়- তখনতো আশঙ্কা সত্যিই জাগে বাংলার ভবিষ্যৎ নিয়ে। এ দীনতা কার বাংলা নাকি তথাকথিত শিক্ষিত নামধারী গুণী ব্যক্তিদের! নাকি বাংলাকে যথাযথ সম্মানের জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করতে না পারার ব্যর্থতা রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত ক্ষমতাসীনদের! কী অদ্ভুত এর কৈফিয়ত নেই। বাংলা ভাষা যে ক্রমশ ধ্বংসের দিকে এগোচ্ছে তাওতো পরিস্কার। যদিও অনেকেই মনে করেছেন বাংলাটির দরকার কী। আপনি কোনো অফিসে গিয়ে সুন্দর শুদ্ধ বাংলাভাষায় কথা বলে কাজটি উদ্ধার করতে যতোটুকু সময় লাগবে, তার থেকে অনেক কম সময় লাগবে ঐ কথাগুলোই ইংরেজিতে বললে। বাংলা বললে ব্যক্তিত্ব প্রকাশ পায় না, ইংরেজিতে নাকি ব্যক্তিত্ব শাণিতভাবে ফুটে ওঠে। যদি তাই হয় তাহলে সত্যি সেটি আমাদের দুর্ভাগ্য। কারণ যিনি নিজের মাতৃভাষার কদর জানেন না, যিনি নিজের মাতৃভাষাকে সম্মান করেন না, তিনি যতোবড়ই হোন অন্তত সুস্থ মানুষ হিসেবে তাকে ধরে নেয়া কঠিন। বর্তমানে বাংলা পড়াকে অনেক পরিবার থেকে নিরুৎসাহিত করা হয় এবং সেই নিরুৎসাহিত করা হয় অবজ্ঞা অবহেলার সঙ্গে। তখন কোন উত্তর থাকে না। বাণিজ্যিক হিসেবে বাংলা একেবারেই নেই। আশ্চর্য হতে হয়, ভাষার মাস ফেব্র“য়ারি। সারা পৃথিবীতে এখন একুশে ফেব্র“য়ারি দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়। কিন্তু এই দেশে ফেব্র“য়ারি মাসের নতুন প্রজন্ম বাংলঅ ভাষা বলতে আগ্রহ বোধ করে না। এমনকি অনেকে জানে না। এ মাসটি ভাষার মাস। এটা যে আমাদের কত বড় দৈন্য, নিজেই কুণ্ঠিত হই। বাংলা ভাষাকে যদি চেতনার জায়গা থেকে সরিয়ে শুধু জীবন-জীবিকার পন্থা হিসেবে গ্রহণ করতে হয়, তাহলে সেটা বেদনাদায়ক। এই চিন্তার ভেতর অন্তসারশুন্যতাই প্রকাশ পায়। যে মা জন্ম দিয়েছেন, তিল তিল করে বড় করেছেন, মানুষ করেছেন, সেই মায়ের দায়িত্ব পালনে যদি ব্যবসা-বাণিজ্যের সূত্র প্রয়োগ ঘটানো হয়, তাহলে মায়ের সঙ্গে সন্তানের সম্পর্কের চিরকালীন যে পবিত্রতা সেখানে ভয়ঙ্করভাবে আঘাত করা হয় শাশ্বত বিশ্বাসকে ভেঙে দেয়া হয়। মাতৃভাষা কী তা নয়! মধ্যযুগের কুিব আব্দুল হাকিম বহু আগেই বলেছেন, যে জন বঙ্গেতে জন্মে হিংসে বানী সে জন কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি এই বাণী এখনও সত্য। বাংলা ভাষার সম্মানটুকু ফিরে আসুক, চিনে নিক বাঙালি আর বুঝে নিক দৃর্বত্ত। কিন্তু অপেক্ষা কতোকাল আর!

add 1


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

অন্যান্য লেখা সমূহ

আজকের দিন-তারিখ

  • মঙ্গলবার (ভোর ৫:০৩)
  • ৩ ডিসেম্বর, ২০২৪
  • ৩০ জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬
  • ১৮ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ (হেমন্তকাল)
Raytahost Facebook Sharing Powered By : Sundarban IT