• আজ- শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ০৭:৪৯ পূর্বাহ্ন
Logo

দিলওয়ারার মন্দির-কীর্তির কীর্তিকথা

মনিরুজ্জামান মুন্না / ৩১৫ বার দেখা হয়েছে
আপডেট : শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

add 1
  • মনিরুজ্জামান মুন্না

বশিষ্ঠ মুনি হিমালয়ে শিবের তপস্যা শেষ করে বর চাইলেন- ‘এরপর তিনি যেখানে বসবাস করবেন, তাঁর তপস্যাপূত হিমালয়ের অংশটুকু সেখানে স্থানান্তরিত করা হোক!’ বশিষ্ঠ রাজপুতনায় এসে অবস্থান করলেন। এ অঞ্চল তখন সমতল প্রান্তর। সেখানে অচিরেই এক গগনচুম্বী পর্বত দেখা দিল। অর্থাৎ বশিষ্ঠদেবের জায়গীর সেই হিমালয়ের টুকরোটি বেশ ভাঙাচোরা অবস্থায় রাজপুতনায় এসে পৌছালো। যার নাম দেওয়া হল ‘আরাবল্লী’। আরাবল্লী পর্বতমালার সর্বোচ্চ চূড়ায় আবু শহর। শিলিগুড়ি-দার্জিলিং বা গৌহাটী-শিলং সড়কের সঙ্গে আবু রোড থেকে মাউন্ট আবু অবধি আঠারো মাইল পথ। বশিষ্ঠদেব হিমালয় থেকে হাঁটাপথে এতদূর এসে আরাবল্লী পাহাড়ের চুড়ায় ডেরা বাঁধলেন। হিমালয় থেকে পাহাড়ে বসে বিশাল্যকরণীর মত তিনি সবশুদ্ধেই এখানে নীত হলেন। পরে ডেরাকে কেন্দ্র করে সেখানে একটি আশ্রমও গড়ে ওঠে। বশিষ্ঠের ঐ আশ্রমের কাছে এক গভীর ফাটল সিধা পাতালে নেমে গেছে। মুনির কামধেনু নন্দিনী একদা সেই গহবরে পড়ে চিৎকার জুড়ে দিল। তবে আশ্চর্যের বিষয়, আত্মরক্ষার নিমিত্তে নিজের ইচ্ছা পুরণ করার কোন ক্ষমতাই তখন কামধেনুর ছিল না। নন্দিনীর কাতর চিৎকারে মুনিপ্রবর সরস্বতী নদীকে স্মরণ করলেন, আর অমনি সরস্বতীর স্রোতধরায় সেই গভীর গহবর ভরে গেল। জলের উচ্চতার লিফটে চড়ে নন্দিনী সে যাত্রায় উপরে উঠে এলেও বশিষ্টদেব ভাবলেন- যেকোন সময় এমন দুর্ঘটনা আবার ঘটতে পারে। তাই এর একটা স্থায়ী প্রতিকারের জন্য তিনি কৈলাসে শিবের শরণাপন্ন হলেন। শিব পরামর্শ দিলেন, হিমাচলের কাছে যাও, সে একটা ব্যবস্থা করতে পারবে। শিবের কথামত বশিষ্ঠ হিমাচলের কাছে গিয়ে উক্ত আবেদন উপস্থাপন করলেন। বৃদ্ধ হিমাচল তাঁর পুত্রদের ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, মুনির এ দায় উদ্ধার করতে তোমাদের মধ্যে কে রাজী। সবাই চুপচাপ থাকলে অবশেষে খোড়া কনিষ্ঠ পুত্র নন্দীবর্ধন স্বীকৃত হলেন। কিন্ত খোঁড়া পা নিয়ে এতদূর যাওয়াই তার পক্ষে এক সমস্যার ব্যাপার হয়ে দাঁড়ালো। তখন স্থির হল নন্দীবর্ধনের বন্ধু, নাগশ্রেষ্ট অর্বুদ তাকে বয়ে নিয়ে যাবে এই শর্তে যে, অর্বুদের নামেই এপর্বতের নামকরণ করতে হবে। বশিষ্ঠ সেই শর্তে রাজি হলে নন্দীবর্ধন ও অর্বুুদ দুই বন্ধু আবু পাহাড়ের ফাটলে গিয়ে ঝাঁপ দিয়ে পড়লেন। এরপর টলমলে সে জলাধারে অর্বুদকে আর দেখা গেল না আর মাটির উপরে জেগে রইল শুধু নন্দীবর্ধনের নাকের ডগাটুকু। এদিকে জলের তলদেশের গহ্বরে লুপ্ত নাগশ্রেষ্ঠ অর্বুদের ছটফটানিতে বশিষ্ঠের আশ্রমে ঘন ঘন ভূমিকম্প হতে লাগলো। বোঝা গেলো পাকাপোক্ত প্রতিকারের কিছু হল না, নন্দিনীর প্রাণ বাঁচাতে গিয়ে ভূমিকম্পের তোড়ে এখন বশিষ্ঠের নিজের প্রাণও ওষ্ঠাগত। নিরুপায় হয়ে এবার বশিষ্ঠদেব কাশী-বিশ্বনাথকে স্মরণ করলেন। দেবাদিদেব মহাদেব বারাণসীধামের মন্দির থেকে ভূগর্ভ দিয়ে তাঁর এক পা অর্বুদ পাহাড় অবধি প্রসারিত করে দিলেন। সাত-আটশো মাইল অতিক্রম করে এসে সেই পায়ের বুড়ো আঙুল দেখা দিল আবু পাহাড়ের চূড়ায়। ভূমিকম্প বন্ধ হল। ভূমিকম্পে আবু পাহাড়ের প্রলংকর প্রতাপকে অচল করে দেওয়ার যিনি কারণ সেই শিব রূপী কাশি-বিশ্বনাথের নামে সেখানে একটি সুদৃশ্য মন্দির নির্মাণ করা হয়। যার নাম দেওয়া হয় ‘অচলেশ্বর মন্দির’। যেখানে কাশী-বিশ্বনাথ অচলেশ্বর শিব নামে পুজো পেয়ে থাকেন। বুড়ো আঙ্গুলের স্পর্শ পেয়ে মাটির যে অংশে তার প্রতিকৃতি স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল, সেখানে মাটি জমাটবদ্ধ হয়ে উক্ত আঙ্গুলের সদৃশ একটি কঠিন শিলা বা পাথরের সৃষ্টি হয়েছিল। আবু শহর থেকে তিন ক্রোশ দূরে অচলেশ্বর মন্দিরে পুণ্যকামীরা আজও একটি পাথর বাঁধানো গর্তের মধ্যে অবিচল দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন। অন্ধকার সয়ে এলে, গর্তের মধ্যে হলদে রঙের একটি পাথর নজরে পড়ে। যা দেবাদিদেবের সেই বৃদ্ধ আঙুল বলে ধরা হয়।
দিলওয়ারা মন্দির সম্বন্ধেও একটা কিংবদন্তী আছে, তবে সেটা অচলেশ্বরের মত অত জমজমাট নয়। গুজরাটের অরাসুর পর্বতে দেবী অম্বিকার মন্দিরের সন্নিকটে বাস করতেন বিমল শাহ। জৈন তীর্থংকর পার্শ্বনাথের উপাসনার জন্য তিনি সেখানে তিনশত ষাটটি মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। এতে ঈর্ষাপরবশ হয়ে দেবী অম্বিকা একদা বিমল শাহকে জিজ্ঞাসা করলেন, কার প্রসাদে তিনি এই মন্দিরগুলি নির্মাণ করেছেন। বিমল শাহ উত্তর দিলেন তার জৈন গুরুর প্রসাদে। তিনবার দেবী এই প্রশ্ন করলেন; তিনবারই বিমল শাহ একই জবাব দিলেন। শুনে ক্রোধে রক্তবর্ণ হল দেবী অম্বিকার মুখ। রাগের প্রলয়ংকরে অমনি ভূমিকম্প শুরু হয়ে মন্দিরগুলি ভেঙে পড়তে লাগলো। মাত্র পাঁচটি মন্দির অবশিষ্ঠ রেখে ক্রুদ্ধা দেবী কিছুটা নিরস্ত হলেন। বললেন, বিস্তীর্ণ ধ্বংসাবশেষের মধ্যে সাক্ষী হয়ে এই ক’টা মন্দির মানুষের কাছে ঘোষণা করুক- দেবী অম্বিকার কোপের পরিণতি কী ভয়াবহ। গুজরাটে অম্বিকার মন্দির থেকে রাজপুতনার অর্বুদশিখর অবধি এক সুড়ঙ্গ পথ ছিল। বিমল শাহ দেবী অম্বিকার প্রলয়ংকারী রোষানলে পড়ে প্রায় অর্ধমৃত অবস্থায় উক্ত সুড়ঙ্গ দিয়ে আবু পাহাড়ের অর্বুদ প্রান্তে পৌঁছালেন। অম্বিকাও ক্ষণকাল পরে আবু পাহাড়ে আবির্ভূতা হলেন। তিনি বিমল শাহকে বললেন, তোমার ব্যক্তিগত কোন অনিষ্টই আমি করতে চাইনি, আর ভবিষ্যতেও কখনো তা করব না, যদি এই অর্বুদ চুড়ায় তুমি আমার জন্য একটি মন্দির নির্মাণ করিয়ে দাও। বিমল শাহ ১০৩১ খৃৃষ্টাব্দে আবু পাহাড়ে দুটি বিখ্যাত মন্দির নির্মাণ করেন। দেবী অম্বিকার রোষের কারণ নিরসনে ও মনোবাসনা পুরনার্থে তার একটি দেবী অম্বিকার নামে অন্যটি বিমল শাহের নামে খ্যাত। প্রথমে বিমল শাহের মন্দির। প্রশস্ত অঙ্গনের মাঝখানে জৈন তীর্থকর আদিনাথের কক্ষ। শিখর বলতে সামান্য যা আছে তা এ গৃহেরই ওপর। প্রবেশদ্বার আর আদিনাথের প্রকোষ্ঠের মাঝখানে নাটমণ্ডপ। অনতিদূরে প্রাঙ্গণের এক পাশে দেবী অম্বিকার পৃথক মন্দির কক্ষে ভীমা ভয়ঙ্করী অদ্যাবধি সভয়ে ও শ্রদ্ধায় পুজিতা হয়ে থাকেন।
আবু পাহাড়ের পাদদেশে গাছ-গাছালির মধ্যে কিছু ছোট-ছোট সাদা বাড়ির মত মন্দিরের দেখা মেলে। ঐগুলিই দিলওয়ারা মন্দির। বাহিরের ভাস্কার্যবিহীন দেওয়ালগুলি শুধুমাত্র চুনকাম করা। কাছে গিয়েও যার বাহ্যিক জৌলুষহীন, সাদামাটা অবয়ব যে কোন দর্শনার্থীকে হতাশ করবে। চূড়ার উচ্চতা চল্লিশ ফিটও হবে কিনা সন্দেহ। তবে এই প্রাথমিক নৈরাশ্যই সম্ভবত ভেতরে প্রবেশ করার পর দর্শককে অধিকতর মুগ্ধ ও অভিভূত করে ফেলে। সেখানে নামী-দামী শ্বেতপাথরের এত অজস্র ও সুনিপুণ কারুকাজ পরিলক্ষিত হবে যা দুনিয়ার আর কোথাও মিলবে না। অপূর্ব কারুকার্যখচিত অনেকগুলি মর্মরস্তম্ভ ও ততোধিক কুশলতায় রচিত গম্বুজাকৃতি ছাত দর্শককে বিস্ময়ে একেবারে হতবাক করে ফেলে। দিলওয়ারা মন্দিরগুলির শ্রেষ্ঠতমসজ্জা নাটমণ্ডপের কেন্দ্রীভূত গঠনশৈলী। মাদুরার মিনাক্ষী বা বেলুড়ের চেন্ন কেশবের মন্দিরে, শ্বেতপাথরের না হলেও, উৎকৃষ্ট ভাস্কর্যমণ্ডিত বহু স্তম্ভ আছে, কিন্তু গোলাকার ছাতের অভ্যন্তরীণ সজ্জায় যে অসামান্য দক্ষতা দিলওয়ালায় নিয়োজিত হয়েছে, তার ধারে-কাছে আসতে পারে, এমন কিছুর অস্তিত্ব পৃথিবীতে কোথাও নেই। এর প্রত্যেকটির প্রবেশপথে অপরূপ মর্মর ভাস্কর্য আর ভেতরে এক একটি জৈন তীর্থংকরের মূর্তি। এর কক্ষ গুলির সামনে দিয়ে একটি নীচু ঢাকা বারান্দা অঙ্গন প্রদক্ষিণ করে এসেছে। এর দালানের ছাতেও শ্বেতপাথরের যে নক্সাগুলি সন্নিবিষ্ট হয়েছে, কারিগরির মুনশিয়ানা ও ব্যঞ্জনার লালিত্যে তা সত্যিই অনন্য অপূর্ব।
দিলওয়ারার অবশিষ্ট দেবালয়গুলির মধ্যে তেজোপাল ও বাস্তুপালের মন্দিরই সমধিক বিখ্যাত। তীর্থংকর নেমিনাথের নামে এটি উৎসর্গকৃত। অঙ্গনের মধ্যকক্ষে তাঁর স্মরণে নিয়মিত শ্রদ্ধাঞ্জলী দিবেদিত হয়ে থাকে। শিলালিপি থেকে জানা যায়, তেজোপাল ও বাস্তুপাল দুই ভাই। ১২৩১ খৃষ্টাব্দে তাঁরা এ মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন। আয়তনে, ভাস্কর্যের প্রাচুর্য ও নিপুণতায়, বিশেষ করে নাটমণ্ডপে অসামান্য সজ্জায় এ মন্দিরটিকে অনেকে বিমল শাহের মন্দিরের থেকেও শ্রেষ্ঠ মনে করেন। দু’শো বছরের অগ্রসর চর্চার ফলেও স্থাপত্য শৈলীর কোন পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু কঠিন মর্মরের মাধ্যমে যে কী অপরূপ লালিত্য বিকশিত হতে পারে তা এ মন্দিরটি না দেখলে কল্পনা করাও কঠিন।
দিলওয়ারাকে সন্নিবেশ করে চূড়া থেকে সমগ্র আবু পাহাড় জুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বেশ কিছু খ্যাত-অখ্যাত মন্দির। মন্ত্রমুগ্ধের মত সারাদিন ঘুরে বেড়িয়েছি এ-মন্দির থেকে ও মন্দির। যেদিকে তাকাই, চোখ যেন আর ফিরতে চায় না। দেওয়ালে দেওয়ালে ‘শত্রুঞ্জয় মাহাত্ম্য’ থেকে উৎকীর্ণ কত কাহিনী; কত গন্ধর্ব-কিন্নরের শোভাযাত্রা। অপরূপ লতাপল্লবে সজ্জিত মর্মরস্তম্ভে কত নৃত্যরতা সুরসুন্দরী। সূর্য মেঘে ঢাকা পড়লে, তাদের কোমল লালিত্য মনকে বিমোহিত করে। আবার খোলা অঙ্গনে যখন প্রখর সূর্যকিরণ প্রতিফলিত হয় তখন আলোয় ঝলমল করে ওঠে এই মর্মর স্বপ্নীল শোভাঅম্বরী। মনে হবে সর্বময় নন্দনের অসাধারণ বিন্যাস আর বৈচিত্র্যের এক অপরূপ ছবির ক্যানভাস। আলোছায়ার এত বিচিত্র সুকুমার ক্রীড়া অন্য কোন মন্দির সমারহে কারও কল্পিত হয়েছে বলে আমার জানা নেই। এসব পৌরাণিক কিংবদন্তীর ঐতিহাসিক নিদর্শন ও কীর্তিমান সৃষ্টির দর্শন এক উচ্চমার্গের ভক্তি আনন্দ আর গুরুত্ব বহন করে। সাথে তীর্থধাম পরিভ্রমণের পূর্ণী তো আছেই। শ্যামলিমার আধিক্য না থাকলেও ফিরে সে প্রকৃতির বসনে নীলিমার নীল আর গোধূলীর রঙে আপন মনে আল্পনা আঁকি, লিখে যাই তার কথা মন্দির দর্পণে।

লেখক : সাধারণ সম্পাদক, সাতক্ষীরা সিকান্দার একাডেমি।

add 1


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

অন্যান্য লেখা সমূহ

আজকের দিন-তারিখ

  • শনিবার (সকাল ৭:৪৯)
  • ২৭ জুলাই, ২০২৪
  • ২০ মহর্‌রম, ১৪৪৬
  • ১২ শ্রাবণ, ১৪৩১ (বর্ষাকাল)
Raytahost Facebook Sharing Powered By : Sundarban IT