ভোর বেলা কলিং বেলের শব্দ শুনে ঘুম ভেংগে গেল।
নভেম্বর মাস। ভোর বেলা এখন এখানে বেশ ভালই কুয়াশা পড়ে। সেই সাথে বয় উত্তুরে হাওয়া।
মাস ছয়েক হল দিনাজপুরে বদলি হয়ে এসেছি। এখানে শীতের সময় নাকি জাকিয়ে শীত নামে। ঢাকায় তো আমরা ডিসেম্বরেও তেমন শীত পাইনা। হয়ত দু কোটি মানুষের ঘিঞ্জি শহরে ইট পাথরের ভিড়ে শীতু বুড়ি তেমন একটা সুবিধে করতে পারেনা। এখানে তেমন টি হবার জো নেই। একে তো শহর টা বেশ ফাকা ফাকা তায় আবার উত্তরে হিমালয়ের কাছাকাছি। ফলে শীতের সময় ভালই শীত পড়ে
স্থানীয় রা বলেছে কখনো কখনো এক দুই সপ্তাহ নাকি সুর্যের আলোই দেখা যায়না।
এক নাগাড়ে বেজেই চলেছে বেল। নিজেকে কোন মতে টেনে তুল্লাম বিছানা থেকে। এই সময়ে কে আসবে ভাবতে ভাবতে ঘুম ঘুম চোখে দরজা খুলতেই আমি সারপ্রাইজড।
হাসিব দাড়িয়ে আছে।হাসিব হল আমার স্কুল ফ্রেন্ড।
দোস্ত তুই!
হ্যা দোস্ত চলে এলাম।ক দিন থাকব।
হাসিব আছে আমার সাথে দু সপ্তাহ হয়ে গেল।আমার এমনি তে কোন সমস্যা নেই। ব্যাচেলর কোয়ার্টারে একা থাকি। সংগি একজন থাকলে ভালই লাগে।কিন্তু হাসিব গত ২ সপ্তাহে এক দিন ও বাসায় কোন ফোন করেনি।ডিউটি শেষ করে ওকে নিয়ে ঘুরতে বেরুই প্রতি দিন। এর মাঝে ওকে নিয়ে দেখিয়ে আনলাম রাজবাড়ি রামসাগর স্বপ্ন পুরি। ওখানে একটা স্কুল আছে যার পুরো বিল্ডিং টা ই বাশ আর মাটি দিয়ে তইরি।নাম হল দীপশিখা স্কুল। সেখানেও নিয়ে গেলাম একদিন। একদিন নিয়ে গেছিলাম উত্তরের সর্ব শেষ পয়েন্ট বাংলা বান্ধা জিরো পয়েন্ট। ওকে নিয়ে ঘুরলাম পঞ্চ গড়ে সমতলের চা বাগান কাজী এন্ড কাজী টি স্টেটের চমৎকার আনন্দ ধারা রিসোর্ট ঠাকুর গাও এর বালিয়া ডাংগির দু বিঘা জমির উপরে ছড়ানো প্রাচীন সুর্যপুরি আম গাছ।
খেয়াল করলাম এসব জায়গায় আমার সাথে সে ঘুরেছে ঠিক ই কিন্তু তার যেন কোন উচ্ছাস নেই। সারাক্ষণ কেমন যেন মন মরা ভাব। তার যেন কোন।কিছুতেই আগ্রহ নেই। গভীর রাতে মাঝে মাঝে ঘুম ভেংগে গেলে দেখি সে আকাশের তারার দিকে তাকিয়ে আছে তন্ময় হয়ে।
হাসিব এমনিতে চাপা স্বভাবের ছেলে। আর আমার স্বভাব হল কেউ নিজ থেকে কিছু না বলতে চাইলে আমি তাকে খুচা খুচি করিনা।
তবে এর মাঝে কয়েক বার জিজ্ঞেস ও করেছি বাসায় ফোন দিচ্ছিস না কেন? সে এটা ওটা বলে এড়িয়ে যায়। আমি অবশ্য ওর মা কে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছি ও আমার এখানে আছে। কোন চিন্তা যেন না করেন।
ওর কী হয়েছে আন্টি ও কিছুই বলেন নি।তবে বুঝলাম আমার এখানে থাকায় উনি বেশ নিশ্চিন্ত
একদিন আমি ডিউটি সেরে এসে বিকেলে চা খাচ্ছি ওকে নিয়ে সে বলল
দোস্ত আমি যে এত দিন আছি তোর খুব ঝামেলা হচ্ছে তাই না?
ছিহ কী বলছিস এসব। তোর যত দিন মুঞ্চায় থাক না
আসলে কি জানিস দোস্ত আমার না বাচতে ইচ্ছে করে না একদম
বলিস কি??
হ্যা রে দোস্ত। আমি আসলে আর বাচতে চাইনা।
কি হয়েছে বল ত?
এর পর হাসিব আমায় যা বলল এ যেন গল্প উপন্যাস এর কাহিনিকেও হার মানায়
তিন বছর ধরে ফেসবুকে পরিচয় কেয়ার সাথে। প্রথমে হাই হেলো এর পরে বন্ধুত্ব তার পরে ঘনিসঠ তা। প্রথমে কেয়া মোটেও চায়নি। কিন্তু হাসিব তাকে প্রচন্ড ভালবেসে ফেলে। কেয়ার সাথে কোন দিন ভিডিও কলে কথা হয়নি। মেসেঞ্জারেই যা আলাপ। একদিন হাসিব ওর সাথে দেখা করতে চায়। প্রথমে রাজি হয়না। পরে বহু পীড়াপীড়ি তে রাজি হল। যেদিন দেখা হল চমকে গেল। কেয়া হল ট্রান্স জেন্ডার। কিন্তু হলে কি হবে হাসিব একেই বিয়ে করতে চায়।আমাদের সমাজ ব্যবস্থা তো আর এরকম বিয়ে মেনে নেবেনা।স্বাভাবিক ভাবেই হাসিবের পরিবার ও প্রবল আপত্তি করে। এটাই তো স্বাভাবিক। আংকেল একদম এক কথা বলে দেন এরকম হলে তিনি তাকে ত্যাজ্য পুত্র করে দেবেন।কিন্তু কোন ভাবেই এ বিয়ে মানবেন না। আইন গত ভাবেও এই বিয়ে হয় ও না। হাসিব এটা জানল তার এক উকিল বন্ধুর কাছ থেকে। এ নিয়ে তার পরিবারের মধ্যে ঘোর অশান্তি। এর ভেতরে রোড এক্সিডেন্টে কেয়া মারা যায়।এটা হাসিব আর সহ্য করতে পারেনি। এক গাদা ঘুমের অসুধ খেয়ে বসে। হাসিবের বড় ভাই ডাক্তার হউয়ায় উনি ব্যাপারটা ধরে ফেলেন এ যাত্রায় হাসিব বেচে গেলেও তাকে ভর করে মারাত্মক বিষন্নতা। মানসিক রোগের ডাক্তার দেখানো হয়। চলে বিভিন্ন অসুধ।কাজের কাজ কিছুই হয়না। একদিন বাড়ির কাউকে কিছু না বলে রাতের ট্রেন ধরে আমার এখানে চলে আসে।
বন্ধু আমার বাচতে আর ইচ্ছে করেনা রে।
আজ হাসিব কে নিয়ে এলাম ডালিয়া।তিস্তা ব্যারেজ দেখাতে। জায়গা টা বেশ সুন্দর।আমরা নীচের দিকে নেমে একটা ছোট্ট ডিংগি নৌকা দেখলাম।
এটার মালিক ছোট্ট একটা বাচ্চা ছেলে। ওর হাতে পঞ্চাস টাকার একটা নোট গুজে দিতেই ও রাজি হল নৌকায় ঘুরাতে। আমরা নৌকা নিয়ে ঘুরছি। হঠাত কি হল গেল নৌকা টা উলটে আমরা দুজন পানিতে। হাসিব পানিতে খাবি খাচ্ছে।একটু পরে ডুবে গেল।আমি আর অই ছেলেটা মিলে তাকে পাড়ে এনে তুললাম। উপুর করে শুইয়ে তার বুক থেকে পানি বের করলাম।বার কয়েক কাশি দিল।এর পর আস্তে আস্তে তার চেতনা ফিরে এলো।
বন্ধু এখন কেমন লাগছে??
আহ আমি বেচে আছি!!! বিশ্বাস ই হচ্ছেনা।আহ কী শান্তি।জীবন এত মধুর আজ বুঝলাম। থ্যানক্স দোস্ত আমাকে নতুন জীবন দিলি।
পরদিন থেকে হাসিব অন্য হাসিব হয়ে গেল।
দুদিন পর হাসিব বলল ট্রেনের টিকিট করে ফেললাম। আজ রাতেই চলে যাচ্ছি।
সে কী রে। থেকে যা না আর কটা দিন। তোকে রংপুরের দিক টা ঘোরানো তো বাকি রয়ে গেল
না রে দোস্ত অনেক জ্বালিয়েছি। মা নিশ্চই অস্থির হয়ে আছে আমার জন্যে।
ওকে রাতে স্টেশনে এগিয়ে দিয়ে এলাম
মাস ছয়েক পরে হাসিবের বিয়ের দাওয়াতের কার্ড পেলাম।
শেষে পাঠকদের একটা কথা বললেই না। সেদিনের ডিংগি নৌকা টা সবার অলক্ষে আমি ই উলটে দিয়েছিলাম। জানতাম শীতের তিস্তায় তেমন পানি থাকেনা।