আন্তর্জাতিক ডেস্ক: গাজায় ইসরায়েলের অব্যাহত হামলা, অবরোধ এবং দুর্ভিক্ষে প্রতিদিনই বাড়ছে প্রাণহানির সংখ্যা। বোমাবর্ষণ, গুলিবর্ষণ, অনাহার আর অপুষ্টিতে প্রতিনিয়ত মৃত্যুর মিছিল লম্বা হচ্ছে। সর্বশেষ একদিনে গাজায় ইসরায়েলি হামলায় কমপক্ষে ৬৮ জন নিহত হয়েছেন।
ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ইসরায়েলি আগ্রাসনে এখন পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন ৬৪ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি। শুধু শনিবার পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬৪ হাজার ৩৬৮ জনে। গত ২৪ ঘণ্টায় গাজার বিভিন্ন হাসপাতালগুলোতে আরও ৬৮ জনের মরদেহ আনা হয়েছে। একই সময়ে আহত হয়েছেন ৩৬২ জন, এতে মোট আহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৬২ হাজার ৩৬৭ জনে।
মন্ত্রণালয় জানায়, এখনো বহু মানুষ ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছেন। উদ্ধারকর্মীদের পর্যাপ্ত সরঞ্জাম না থাকায় কিংবা অব্যাহত বোমাবর্ষণের কারণে তাদের উদ্ধার করা যাচ্ছে না। রাস্তায়ও পড়ে আছে বহু মরদেহ, যেগুলো সংগ্রহ করাও সম্ভব হচ্ছে না।
মানবিক সহায়তা নিতে গিয়েও প্রাণ হারাচ্ছেন বহু ফিলিস্তিনি। গত ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে আরও ২৩ জন নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন অন্তত ১৪৩ জন। চলতি বছরের ২৭ মে থেকে এখন পর্যন্ত শুধু সহায়তা সংগ্রহ করতে গিয়েই নিহত হয়েছেন ২ হাজার ৩৮৫ জন এবং আহত হয়েছেন ১৭ হাজার ৫৭৭ জনের বেশি।
ক্ষুধা ও অপুষ্টিও গাজার মানুষের জন্য বড় হুমকিতে পরিণত হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় অনাহারে মারা গেছেন আরও ৬ ফিলিস্তিনি, যার মধ্যে একজন শিশু। ফলে গত বছরের অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত ক্ষুধাজনিত মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৮২ জনে। এর মধ্যে শুধু শিশুই রয়েছে ১৩৫ জন।
গাজাকে চরম দুর্ভিক্ষে ঠেলে দিয়েছে ইসরায়েলের আরোপিত অবরোধ। গত ২ মার্চ থেকে গাজার সব সীমান্ত ক্রসিং সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে ২৪ লাখ মানুষের এই ছোট্ট ভূখণ্ডে খাদ্য, ওষুধ এবং ত্রাণ পৌঁছানো কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য নিরাপত্তা জরিপে ইতোমধ্যেই গাজার উত্তরাঞ্চলে দুর্ভিক্ষ নিশ্চিত হয়েছে। সংস্থাটি আশঙ্কা করছে, চলতি মাসের শেষ নাগাদ দুর্ভিক্ষ দক্ষিণাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়বে।
শুধু অবরোধ নয়, হামলাও চলছে সমানতালে। গত ১৮ মার্চ থেকে নতুন করে শুরু হওয়া ইসরায়েলি সামরিক অভিযানে এ পর্যন্ত ১১ হাজার ৮২৮ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৫০ হাজার ৩২৬ জন। এতে জানুয়ারিতে হওয়া যুদ্ধবিরতি ও বন্দি বিনিময় চুক্তি কার্যত ভেঙে গেছে।
এদিকে, শুক্রবার গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযান ৭০০তম দিনে প্রবেশ করেছে। দীর্ঘ এ হামলায় গোটা ভূখণ্ড আজ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। হাসপাতালগুলো অচল, পানি-বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ, ঘরবাড়ি মাটির সঙ্গে মিশে গেছে, আর বেঁচে থাকা মানুষগুলো বেঁচে আছেন কেবল হতাশা আর ক্ষুধার্ত শরীর নিয়ে।
অন্যদিকে আন্তর্জাতিক পরিসরেও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে মামলা চলছে। গত বছরের নভেম্বরে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) গাজায় যুদ্ধাপরাধের দায়ে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এবং সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োয়াভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। একইসঙ্গে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে মামলাও চলমান রয়েছে।
গাজার মানুষ তাই এখন দুই দিক থেকে মৃত্যু বরণ করছে—ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে কিংবা বোমা-গুলিতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে, আর খাবারের অভাবে অনাহারে দিন কাটাতে কাটাতে। মৃত্যুর মিছিল থামছেই না।