ভূমিকা : শক্তির দেবী, ভক্তির দেবী, মঙ্গল ও কল্যাণের দেবী হিসেবে সু-প্রাচীন যুগ থেকে আত্মপীড়িত মানুষের কাছে পুজিত হয়ে আসছেন বিশ্বখ্যাত যশোরেশ্বরী কালীমাতা। ইতিহাস ঐতিহ্যে সমুর্জ্জল ভারতীয় উপমহাদেশের ঐতিহাসিক শক্তিপীঠ মন্দির রূপে খ্যাত। বঙ্গোপসাগর সংলগ্ন সুন্দরবন জনপদের বর্তমান সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলায় ঈশ্বরীপুরে অবস্থিত এই যশোরেশ্বরী কালীমাতা মন্দির। হিন্দু সনাতনী ধর্মীয় সংস্কৃতিতে আপন শক্তি বলে একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে তন্ত্র সাধনা। সাধারণত: শক্তির সাধকগণ তান্ত্রিক হিসেবে বিবেচিত হন। কালীরূপী নারী শক্তি যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন নামে মানুষের কাছে শক্তি ও মঙ্গলের দেবী রূপে পুজিত হয়ে আসছেন। যশোরেশ্বরী উপমহাদেশের একটি অন্যতম পীঠ মন্দির এবং দর্শনীয় স্থান। তাঁর কীর্তি ও মন্দির নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে ইতিহাস ঐতিহ্য এবং ইতিকথা। দেশ-বিদেশের বহু পূর্ণাথী, তীর্থাথী যুগ যুগ ধরে এ পীঠস্থানে গমনাগমন করে থাকেন। এটি ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীনতম পীঠ মন্দির।
নামের উৎপত্তি : লোকজ কাহিনী মতে যশোাহর বা যশো নামে এক পাটনী এই ঈশ্বরী নামীয় দেবীকে যমুনা পারাপার করাকে কেন্দ্র করে কালে কালে এখানকার দেবীর নাম হয় যশোরেশ্বরী। আর যে স্থানে দেবীর মন্দির বিদ্যমান, বর্তমানর সে স্থানের নাম ঈশ^রী দেবীর নামানুসারে ঈশ্বরীপুর। প্রবীন মানুষরা আজও বলেন যশোর-ঈশ্বরীপুর। আর এই যশোরেশ্বরী মায়ের নাম থেকে যশোহর বা যশোর নামের উৎপত্তি হয়েছে। এই পীঠস্থানের কথা দেশ বিদেশের বহু ভক্ত-জ্ঞানীগুণী অবগত থাকলেও সময় ও প্রেক্ষাপটের কারণে বর্তমানে অনেকেরই এই যশোরেশ্বরী মন্দির এবং মায়ের প্রতিষ্ঠা ও অবস্থান সম্পর্কে তেমন ধারণা নেই।
যশোহর নামের পত্তন : যশোরেশ্বরী নাম থেকে যশোহর নামের পত্তন হয়েছে। মধ্যযুগে বারো ভুঁইয়ার অন্যতম রাজা প্রতাপাদিত্যের সময়ে এই সুন্দরবন সংলগ্ন জনপদ সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল। বাংলাভাষা চর্চা ও সাহিত্য-সংস্কৃতি, বাঙালি চেতনা জাগরণের অন্যতম স্থান ছিল এই আদি যশোহর রাজ্য। এ অঞ্চলের ড্যামরাইল নবরত্নসভা, গোপালপুর গোবিন্দদেব মন্দিরসহ নানা প্রত্ন নিদর্শন কীর্ত্তণ যুগের কবিদের ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চার স্বাক্ষ্য বহন করে। যশোরেশ্বরী দেবী’র কীর্তি নিয়ে যুগে যুগে ইতিহাস ঐতিহ্য, সাহিত্য-সংস্কৃতি জেগেছ, আবার রঙ্গভরা বঙ্গদেশের লোকমুখে বহু কিংবদন্তি তৈরি হয়েছে। আমরা ইতিহাস এবং পৌরাণিক কাহিনীর আলোকে প্রাচীন ভারতীয় দেবী যশোরেশ্বরী মাতার কথা বলছি।
অবস্থান : বঙ্গপোসাগর উপকূল প্রাচীন এ অঞ্চল বঙ্গদেশের ব্যঘ্রতটী ভুক্তি জনপদ হিসেবে পরিচিত ছিল। পরবর্তীতে এ অঞ্চলকে বুড়োন দ্বীপ বলা হতো। মধ্যযুগে মোঘল শাসনামলে এই যশোরেশ্বরী কালী মাতার নামানুসারে যশোহর রাজ্য বা যশোর দেশ হিসেবে পরিচিত হয়। বর্তমানে স্থানটি সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার ঈশ্বরীপুর গ্রামে অবস্থিত। এটি ৫১ পীঠের একটি হিসেবে পরিচিত। পৌরাণিক মতে সতীর দেহ নিয়ে শিবের তান্ডব নৃত্যকালে বঙ্গোপসাগর উপকুলে সতীমাতার হাতের পাঞ্জা বা পানিপদ্ম পড়ে। পানিপদ্ম বলতে হাতের তালুকে বোঝানো হয়। এখানে দেখা যায় প্রাচীন তন্ত্রচুড়ামণি গ্রন্থে যশোহর বা যশোর নামের উল্লেখ রয়েছে। মধ্যযুগীয় বারোভূঁইয়াদের অন্যতম রাজা প্রতাপাদিত্যের রাজধানী যশোহর বা বর্তমান যশোরেশ্বরীপুর নামক স্থানে, বঙ্গপসাগর ঘেষা সুন্দরবন সংলগ্ন জনপদে।
ইতিহাসের আলোকে যশোহর : ইতিহাসের আলোকে জানা যায়, মোগলদের আক্রমনের মুখে গৌড়ের শেষ পাঠান সুলতান দাউদ খান কররাণীর পরাজয় ও পাঠান শাসনের অবসান হলে সেখানকার পদস্থ রাজকর্মচারী শ্রীহরি ও জানকী বল্লভ পরাজিত পক্ষের লোকলস্কর, ধনসম্পদ নিয়ে নদী পথে আত্মগোপনের লক্ষ্যে গৌড় থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম এই বিচ্ছিন্ন বিপদসংকুল জনপদ সুন্দরবনে এসে ওঠে। তারা জঙ্গল কেটে বর্তমান কালীগঞ্জ উপজেলা ইছামতি-কালীন্দির সন্নিকটে এক স্থানে বসতি স্থাপন করে বসন্তপুর নাম নিয়ে আবাসস্থল গড়ে তোলেন। এর কাজকাছি স্থানে গড়মুকুন্দপুর (বর্তমান কালিগঞ্জে) নামক স্থানে পরিখা বেষ্টনী রাজকীয় দুর্গ নির্মাণ করে বসবাস শুরু করেন। পাশাপাশি জনবসতিও গড়েতোলেন, বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মানুষ এই অঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করেন। এই জনপদে এসে শ্রীহরি ও জানকী বল্লভ বিক্রমাদিত্য ও বসন্ত রায় নাম ধারণ করে বসবাস শুরু করেন এবং ‘যশোহর সমাজ’ নামে সমাজ গঠন করেন। তাঁরা এ অঞ্চলে অধিষ্ঠিত প্রাচীন শক্তির দেবী যশোরেশ্বরীর নাম অনুসরণ করে নতুন এই জনপদের নামকরণ করেন যশোহর পরগণা বা যশোহর রাজ্য। নতুন রাজ্য পরিচালনার জন্যে বিক্রমাদিত্যকে রাজা হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। আর প্রাজ্ঞ, দূরদর্শী বসন্ত রায় রাজ্য রক্ষার কাজে নিয়োজিত হন। তিনি যেমন ছিলেন যাদ্ধা, তেমনি ছিলেন ধর্মপ্রাণ ভাবুক-কবি এবং সামাজিক মানুষ। তাঁরই আগ্রহে তৎকালে যশোহর সমাজ, ড্যামরাইল নবরত্নসভা মন্দির, গোপালপুর গোবিন্দ দেব মন্দির এবং ৯৯ বিঘা জমির উপর খননকৃত দীঘি নির্মিত হয়।
প্রতাপাদিত্য : বিক্রমাদিত্যের পুত্র প্রতাপাদিতা রাজা হওয়ার পর (আনুমানিক ১৫৮৭ খ্রি:) যমুনা ও ইছামতির সঙ্গমস্থলে ঝোপ-জঙ্গল কাটানোর এক পর্যায়ে যশোরেশ্বরীর কষ্টিপাথরের কালী-মূর্তিসহ এক পরিত্যাক্ত ভগ্ন মন্দির আবিষ্কৃত হয়। রাজা প্রতাপাদিত্য কালীমাতাকে কুলদেবতা হিসেবে বরণ করেন এবং ঈশ্বরীপুরে মায়ের মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি রাজ্যভার গ্রহণ করার পর বাবা-কাকা প্রতিষ্ঠিত পরিখা বেষ্টিত গড়, মুকুন্দপুর দূর্গ ও রাজধানী স্থানান্তর করে মায়ের মন্দির সংলগ্ন স্থানে যশোহর রাজ্যের রাজধানী স্থানান্তর করে বারো-দুয়ারি নির্মাণ করে রাজকার্য পরিচালনা করেন।
মন্দিরের প্রাচীনত্ব : যশোরেশ্বরী কালী সম্পর্কে কবিরাম কৃত ‘দিগি¦জয় প্রকাশ’ নামক প্রাচীন গ্রন্থ হতে জানা যায়, ‘পুর্বাকালে অনরি নামক একজন ব্রাক্ষ্মণ দেবীর জন্য এখানে শতদ্বারযুক্ত এক বিরাট মন্দির নির্মাণ করেন। পুনরায় ধেনুকর্ণ নামক এক ক্ষত্রিয় নৃপতি তীর্থ দর্শেন আসিয়া মায়ের ভগ্ন মন্দির স্থলে এক নতুন মন্দির প্রস্তুত করিয়া দেন। ‘সুন্দরবনের ইতিহাস’Ñ এ দেখা যায় যে, সুন্দরবন বহুবার উঠেছে-পড়েছে। কখনো এখানে জনকোলাহলময় লোকালয় ছিল; কখনো তা উচ্চন্ন হয়ে মনুষ্যশুন্য হয়। রাজা প্রতাপাদিত্য যশোরেশ্বরী কালী মায়ের একনিষ্ঠ সাধক ছিলেন। তিনি তার রাজ্যের রাজগুরু কমল নয়ন তর্কপঞ্চাননের মাধ্যমে শক্তিমন্ত্রে দীক্ষিত হন। কথিত আছে মায়ের বরে প্রতাপাদিত্য বহুযুদ্ধে বিজয় অর্জন করায় লোকে তাঁকে যশোরেশ্বরী কালীর বরপুত্র বলতো। বারো ভুঁইয়ার অন্যতম রাজা প্রতাপাদিত্য যশোহর রাজ্য শক্তিশালী করে যশোহরকে স্বাধীন রাজ্য আর নিজকে স্বাধীন রাজা হিসেবে ঘোষণা করেন। মানসিংহ সহ একাধিক মোঘল সেনাপতির সাথে তাঁর যুদ্ধ হয়। সর্বশেষ সুবেদার ইসলাম খাঁ’র শাসন কালে ১৬১০ খ্রি: যুদ্ধে রাজা প্রতাপাদিত্য পরাজিত হন। প্রতাপের পতনের পর মন্দিরটি দীর্ঘ বৎসর অরক্ষিত ছিল। ইসলাম খাঁর অবহেলা জনিত রাজনৈতিক প্রভাব, বনদস্যু ও জলদস্যুর আগ্রাসন, প্রাকৃতিক দূর্যোগসহ নানা কারণে জনবসতি স্থানান্তিত ও ধ্বংস হতে হতে অঞ্চলটি ক্রমান্বয়ে জনশুন্য হয়ে পড়ে। ফলে সঙ্গত কারণে যশোরেশ্বরী কালী মায়ের মন্দির অরক্ষিত ও বিনষ্ট হতে হতে প্রায় ধ্বংস হয়ে পড়ে। তবে শোনা যায়, মাঝে মাঝে দু:সাহসিক দস্যুরা সেথায় অবস্থান করে মায়ের পূজা দিতেন, পরে কিছু সাহসী হিন্দু-মুসলমান বসবাস শুরু করে এই স্থানে। অষ্টাদশ শতকের প্রথম ভাগে বর্তমান আধিকারীদের পূর্বপুরুষ জয়কৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় ব্যবসায়িক কাজে মধ্যযুগের প্রসিদ্ধ এ অঞ্চলে আসেন। এ সময় স্থানীয় অধিবাসীদের মুখে যশোরেশ্বরী মায়ের কথা শুনে তাদের অনুরোধে ঈশ্বরীপুরে বসবাস শুরু করেন এবং সেই সময় থেকে আবার মায়ের পূজা অর্চনা শুরু হয় বলে ধারণা করা যায়। শ্রী সতীশ চন্দ্র মিত্র বলেছেনÑ ‘জয় কৃষ্ণের প্রপৌত্র বিষ্ণুরাম বা তার পুত্র বলরামের সময়ে ইংরেজদের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত শুরু হয়। এই বলরামই মায়ের মন্দির এক প্রকার নতুন করে নির্মাণ করেন।’ এ বিষয়ে উল্লেখ্য ১৭৩১ সালে অর্থাৎ ১৮৩৯ খ্রি: চৈতলী চট্টোবংশীয় পূরন্দরের সন্তান বলরাম বিপ্র এই কালীকাপুরী নির্মাণ করে মায়ের সেবা ও সম্পত্তি ভ্রাতুস্পুত্র কালীকিঙ্করের হাতে সমার্পন করে স্বাগত হন। কালীকিঙ্কর ১৮৪৪ খ্রি: (১৭৬৬ সালে) এই লিপি সংযুক্ত করেন বাংলা লিপিতে যা স্পষ্টকৃত হয়-‘বঙ্গাব্দ বারো শ’ ষোল সাল। পরবর্তীতে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ থেকে উনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে ওই অঞ্চলে ফের জনবসতি গড়ে উঠতে থকে। ফলে এই সময়ে মন্দিরটির পুন:আবিস্কার ও প্রতিষ্ঠার প্রয়াস চলে। সে ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন সময়ে সংস্কারের মাধ্যমে অপেক্ষাকৃত পরিপাটি, ঐতিহ্য আর প্রচীনত্বের স্বাক্ষ্য বহন করে চলে।
প্রতাপাদিত্যের রাজধানী যশোহর নগরীতে শুধুমাত্র যশোরেশ্বরী শোভাবর্ধন করতো তা নয়। তার শাসনামলে এখানে আরো কয়েকটি উপাসনালয় গড়ে উঠেছিল যার অবস্থান প্রায় একই সমান্তরালে। এদের একটি ট্যাংগা মসজিদ (বর্তমানে শাহী জামে মসজিদ) অন্যটি উপমহাদেশের প্রথম যীশুখৃষ্টের গীর্জা। প্রায় দু’কিলোমিটার পশ্চিমে গোপালপুর গ্রামে গোবিন্দদেব মন্দিরমালা (আজও ভগ্নস্তূপ বিদ্যমান)। প্রতাপের সেনাবাহিনীতে হিন্দু, মুসলিম ও খৃষ্টান সৈন্য ছিলেন। তাদের জন্য পৃথক-পৃথক উপসানালয় করে দেয়া হয়েছিল বলে ঐতিহাসিকগণ উল্লেখ করেছেন। প্রতাপের পদাতিক বাহিনী অন্যতম প্রধান ছিলেন খাজা কমল, কতলু খাঁ সহ অনেক মুসলমান সৈন্য। এঁদের প্রার্থনার জন্য যশোরেশ্বরী মায়ের মন্দিরের পশ্চিম পাশে উক্ত ট্যাংগা মসজিদ নির্মিত হয়। আর খৃষ্টানদের জন্য নির্মিত হয় গীর্জা।
মন্দিরের বর্ণনা : বর্তমানে মন্দিরটি ১৮ জোড়া খাম্বা বা খুটির উপরে দন্ডায়মান। এটি একটি অনিন্দ্য সুন্দর নবরত্ন মন্দির। অর্থাৎ দুই ধাপে চারটি করে আটটি এবং চুড়ায় একটি রত্ম, উপরে একটি গোল প্রধান চুড়া গম্বুজ, মন্দিরটি চতুষ্কোণী চারপাশে বারান্দা। উত্তর-দক্ষিণপাশে একই সমস্তরালে দু’টি দরজা এবং পশ্চিমপাশে মায়ের দর্শনীয় সদর দরজা। মন্দির চত্বরের পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণ পার্শ্বে পুরাতন নহবৎ খানা, অতিথিশালা আর দর্শনার্থীদের কক্ষ ভেঙ্গে পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে, সম্ভবত এগুলি ১৯ শতকের দিকে বর্তমান সেবায়িতগণের পুর্বপুরুষগণ অতীতের আঁদলে পুন:সংস্করণ বা নির্মাণ করেন। বর্তমান জনবসতি গড়ে উঠার পর আনুমানিক ১৯৩০-৪০ এর দশকে ঝোপজঙ্গল ও ইটমাটির স্তুপ পরিস্কার করে উক্ত পাঁচগম্বুজ বিশিষ্ট লম্বা মসজিদ আবিস্কৃত হয়। পরবর্তীতে এলাকার ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণের প্রচেষ্টায় পুরাতন অবয়বের ভীত দেয়াল ঠিক রেখে ট্যাংগা মসজিদটি সংস্কার করা হয়। (তবে প্রত্নত্বাত্বিক নিয়ম মানা হয়নি) এখানে প্রায় ১৪ হাত লম্বা একাধিক কবর ছিল। বর্তমানে সেগুলি সংস্কার করে দু’টি কবর পাকা করা হয়েছে। এই মসজিদের পূর্বপাশে সমসাময়িক কালে নির্মিত হাম্মামখানা বা হাফসিখানা ভঙ্গুর অবস্থায় আজও দাঁড়িয়ে আছে। এর পুর্বপার্শে¦ ছিল রাজদরবার। কালীমায়ের মন্দিরের পূর্বপাশে ছিল উপমহাদেশের প্রথম গীর্জা। প্রতাপের নৌ-সেনাবাহিনীতে ডুডলী, রডার প্রমুখ বীর ছিলেন। এদের দৌলতে জেসুইটস পাঁদ্রীগণ প্রতাপের অনুমতি নিয়ে তাঁদের উপসনালয় নির্মাণ করেন ১৫৯৯ খ্রি: এবং এটিই ছিল মধ্যযুগীয় বঙ্গদেশের প্রথম গীর্জা। ১৬০০ খ্রিঃ ১ জানুয়ারিতে রাজা প্রতাপাদিত্যের উপস্থিতিতে পাঁদ্রীগণ জাঁকজমক সহকারে গীর্জা উদ্ধোধন করেন। এটির নাম দেয়া হয়েছিল যীশু খৃষ্টের গীর্জা। প্রতাপের পতনের পর উক্ত গীর্জা আর কোন সংস্কার না হওয়ায় ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। বর্তমানে সে স্থানে বসতবাড়ি গড়ে উঠেছে।
বংশধারা : কাশ্যপ গোত্রীয় জয়কৃষ্ণের ৪র্থ অধস্থন ছিলেন বলরাম। বলরামের বড় ভাই দেবী প্রসাদের পুত্র কালীকিঙ্কর। পরবর্তীতে দেখা যাচ্ছে, বলরামের তৃতীয় অধস্থন জ্ঞান চন্দ্রের পুত্র শ্রী শচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ইনি খুবই জনহিতৈষী এবং মানব দরদী ছিলেন, তৎকালীন খুলনা জেলা বোর্ডের সদস্য ছিলেন, ইউনিয়ন বার্ডের প্রেসিডেন্টও ছিলেন। তাঁর প্রচেষ্টায় ঈশ্বরীপুরে পোস্ট অফিস, দাতব্য চিকিৎসালয়, অতিথিশালা ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। তাঁর ছেলে কালীকানন্দ এবং মাখন লাল চট্টোপাধ্যায় বিগত শতকের ১৯৮০ এর দশক পর্যন্ত সেবায়িতের দায়িত্ব পালন করেন। এঁনারাও এলাকায় সুপরিচিত এবং জনপ্রিয় ছিলেন। বর্তমানে কালীকানন্দের পুত্র জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় ও জ্যোতি চট্টোপাধ্যায় যশোরেশ্বরীর সেবাইতের দায়িত্ব পালন করছেন। এঁরা জয়কৃষ্ণের নবম অধস্থন।
পুন:সংস্কার : প্রায় দুইশত বছর পূর্বে মন্দিরটি পুন:সংস্কার করা হয়েছিল। মন্দির সংলগ্ন যে সকল স্থাপনা যথা নহবৎ খানা, অতিথিশালাসহ অন্যান্য ধ্বংস উন্মুখ স্থাপনাগুলি ঐ সময়ে পুন:সংস্কার বা নির্মাণ করা হয়েছিল পরবর্তী সময়ে মন্দিরটি কিছু কিছু সংস্কার হলেও অনেকাংশ জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে। এরই মাঝে চুয়াডাঙ্গা নিবাসী শিল্পপতি গিরিধারী লাল নামীয় এক ধর্মপ্রাণ ব্যাক্তি তীর্থ দর্শনে এসে মন্দির দেখে শুনে স্ব-উদ্যোগে ২০০১ খ্রিঃ মন্দিরটি কিছু কিছু অংশ মেরামত ও চুনকাম করেন এবং মন্দিরের পূর্বপার্শ্বে একটি একতলা বিশিষ্ট অতিথি ভবন নির্মাণ করে দেন।
শক্তিপীঠ : শক্তিপীঠ হিন্দুধর্মের পবিত্রতম তীর্থগুলির অন্যতম। লোকবিশ্বাস অনুসারে, শক্তিপীঠ নামাঙ্কিত তীর্থগুলিতে দেবী দাক্ষায়ণী সতীর দেহের নানান অঙ্গ প্রস্তরীভূত অবস্থায় রক্ষিত আছে। সাধারণত ৫১টি শক্তিপীঠের কথা বলা হয়ে থাকলেও, শাস্ত্রভেদে পীঠের সংখ্যা ও অবস্থান নিয়ে মতভেদ আছে। পীঠনির্ণয় তন্ত্র গ্রন্থে শক্তিপীঠের সংখ্যা ৫১। শিবচরিত গ্রন্থে ৫১টি শক্তিপীঠের পাশাপাশি ২৬টি উপপীঠের কথাও বলা হয়েছে। কুব্জিকাতন্ত্র গ্রন্থে এই সংখ্যা ৪২। আবার জ্ঞানার্ণবতন্ত্র গ্রন্থে পীঠের সংখ্যা ৫০। ভারতীয় উপমহাদেশের নানা স্থানে এই শক্তিপীঠগুলি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সকল শক্তিপীঠসমূহে শক্তিদেবী ভৈরবের সাথে অবস্থান করেন। এই মন্দিরটি তার প্রাচীন গরিমা হারালেও এক কণাও কমেনি মা যশোরেশ্বরীর মহিমা। বরং তা যেন উত্তরোত্তর বাড়ছে। মা যশোরেশ্বরীর মহিমার কথা শোনা যায় স্থানীয় মুসলিমদের মুখেও। অতীতে তাঁর মহিমার কথা যশোর থেকে পৌঁছেছিল দিল্লির মুঘল রাজ দরবারেও। অম্বররাজ মানসিংহ এক পুরোহিতের সাহায্যে মা যশোরেশ্বরীর বিগ্রহটি চুরি করে নিজের কাছে লুকিয়ে রেখেছিলেন। যশোরের মন্দির থেকে চুরি করা মা যশোরেশ্বরী কালীর বিগ্রহটি রাজস্থানের অম্বর দুর্গে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। কিন্তু বঙ্গবিজয়ের কয়েকদিনের মধ্যেই স্বপ্নে রুষ্ট মাকালীর দর্শন পান। তারপরেই সূক্ষ্মীবতী নদীর তীরে মা কালীর নতুন একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। এদিকে পরবর্তীকালে যশোরের মূলমন্দিরে আবার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা হয় মা যশোরেশ্বরীর বিগ্রহ। যশোরেশ্বরী মাতা ভীষণদর্শন হলেও মায়ের শ্রীবদনে অপূর্ব দেবীভাব গুন ও বৈশিষ্ঠ্য বিদ্যমান।
পৌরাণিক কাহিনী : কিংবদন্তি অনুসারে, সত্য যুগের কোনও এক সময়ে মহাদেবের উপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তার শশুর দক্ষ রাজা বৃহস্পতি নামে এক যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন। কন্যা সতী দেবী পিতার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ‘যোগী’ মহাদেবকে বিবাহ করায় দক্ষ ক্ষুব্ধ ছিলেন (যদিও মহাদেব দক্ষের শর্ত ও প্রতাপি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেরন)। মহাদেব ও সতী দেবী ছাড়া প্রায় সকল দেব-দেবীকে দক্ষ নিমন্ত্রণ করেছিলেন। মহাদেবের অনিচ্ছা সত্ত্বেও সতী দেবী মহাদেবের অনুসারীদের সাথে নিয়ে অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন। কিন্তু সতী দেবী আমন্ত্রিত অতিথি না হওয়ায় তাকে যথাযোগ্য সম্মান দেওয়া হয়নি। অধিকন্তু দক্ষ অনৈতিকভাবে মহাদেবকে বিভিন্ন কারণে-অকারণে অপমান করেন। সতী দেবী তার স্বামীর প্রতি পিতার এ অপমান সহ্য করতে না পেরে যোগবলে আত্মাহুতি দেন। এ খবর শুনে শোকাহত মহাদেব রাগান্বিত হয়ে দক্ষর যজ্ঞ ভণ্ডুল করেন এবং সতী দেবীর মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে বিশ্বব্যাপী প্রলয় নৃত্য শুরু করেন। তখন জগৎ সংসার ধ্বংস হবার উপক্রম হয়। অন্যান্য দেবতারা এই প্রলয় নৃত্য থামানোর জন্য মহাদেবকে অনুরোধ করেন। অবশেষে নিরুপায় হয়ে বিষ্ণুদেব তার সুদর্শন চক্র দ্বারা সতী দেবীর মৃতদেহ ছেদন করেন। এতে সতী মাতার দেহখণ্ডসমূহ ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন জায়গায় ছিটকে পড়ে এবং পবিত্র পীঠস্থান (শক্তিপীঠ) হিসেবে পরিচিতি পায়। পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী শক্তিমান দেবতা শিবের লীলাসঙ্গিনী সতীর সেই দেহ-খন্ডের একখন্ড সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলায় ঈশ^রীপুর পতিত হওয়ার পর তাঁকে কেন্দ্র করে সেই সুপ্রাচীনকাল থেকে মাতা যশোরেশ্বরীর আর্বিভাব ঘটে এবং এই অঞ্চলে তিনি পুজিত হন। ইনি যশোরের পীঠদেবতা হিসেবে সর্বত্রই পরিচিত হন।
ইতিহাস : ধারনা করা হয় যে, মন্দিরটি আনারি নামের এক ব্রাহ্মণ কর্তৃক নির্মিত হয়। তিনি এই যশোরেশ্বরী শক্তিপীঠের ১০০টি দরজা নির্মাণ করেন। কিন্তু মন্দিরটি কখন নির্মিত হয় তা জানা যায়নি। পরবর্তীকালে লক্ষ্মণ সেন ও প্রতাপাদিত্য কর্তৃক তাদের রাজত্বকালে এটির সংস্কার করা হয়েছিল। কথায় আছে যে মহারাজা প্রতাপাদিত্যের সেনাপতি এখানকার জঙ্গল থেকে একটি আলৌকিক আলোর রেখা বের হয়ে মানুষের হাতের তালুর আকারের একটি পাথরখণ্ডের উপর পড়তে দেখেন। পরবর্তীতে প্রতাপদিত্ত্য কালীর পূজা করতে আরম্ভ করেন এবং এই কালী মন্দিরটি নির্মাণ করেন। তৎকালিন জমিদার বাবু মায়ের নামে প্রায় ২০০ বিঘা জমি দান করেছিলেন। কিন্তু আজ প্রভাবশালী ভুমিদস্যুরা জাল দলিল সৃষ্টি করে মায়ের মন্দীরের সব জমি দখল করে ভোগদখল করছে।
মূর্তি : তন্ত্রচূড়ামণিতে বলা হয়েছেÑ ‘যশোরে পানিপদ্ম দেবতা যশোরেশ্বরী,/চণ্ডশ্চ ভৈরব যত্র তত্র সিদ্ধ ন সংশয়।’ অর্থাৎ যশোরে সতীর পাণিপদ্ম বা করকমল পড়েছে। দেবীর নাম যশোরেশ্বরী, ভৈরব হলেন চণ্ড। এই সতীপীঠে কায়মনোবাক্যে পুজো করলে ভক্তের মনোবাসনা পূর্ণ হয় বলে সর্বসাধারণের বিশ্বাস। মন্দির-বেদির ওপর প্রতিষ্ঠিত মাতৃ প্রতিমার শুধু মুখমণ্ডলই দৃষ্টিগোচর হয়। শ্রীযশোরেশ্বরীর কণ্ঠের নিচে তার শ্রীহস্ত ও শ্রীচরণ কিছুই নজরে পড়ে না। মূর্তির অবয়ব পুরোটাই মখমলে আবৃত। মালদার জাগ্রত জহুরা কালীমাতার মুখমণ্ডলের সঙ্গে কিছুটা সাদৃশ্য রয়েছে যশোরেশ্বরীর।
যশোরেশ্বরী মন্দিরের সর্বশেষ অবস্থা : প্রতিবছর কার্ত্তিকী অমাবস্যার দীপাবলি রাতে মন্দিরে খুব ধুমধাম ও জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে যশোরেশ্বরী কালী মায়ের মন্দিরে শ্যামাপুজো অনুষ্ঠিত হয়। মা ভীষণ জাগ্রত। এছাড়া বছরের বিভিন্ন সময়ে দেশ-বিদেশের তীর্থাথী, জিজ্ঞাষু, ভ্রমন পিপাষু মানুষের আগমন ঘটে এই প্রসিদ্ধ যশোরেশ্বরী মন্দিরে। শ্যামাপুজোয় এই মন্দিরে হাজার হাজার ভক্ত পুজো দেন। মানত করেন। বড় করে হোমযজ্ঞ হয়। মাকে নানা অলংকারে সাজানো হয়। মন্দিরের সামনে তিনদিন মেলা বসে। ছাগবলি হয়। যশোরেশ্বরী মাতা ভীষণদর্শন হলেও মায়ের শ্রীবদনে অপূর্ব দেবীভাব রয়েছে। ভক্তের পরম আশ্রয়ের শেষ কথা যেন তিনিই। এই মন্দিরে প্রতি শনি ও মঙ্গলবার নিয়মিত পূজা হয়। শ্রীযশোরেশ্বরীর এ পুজো হয় তন্ত্রমতে। মায়ের পুজোয় সমবেত ভক্তগণ ফুল, ফল, চাল-ডাল, সবজি, দুধ ও নানাধরনের মিষ্টি আনেন। মাতৃমূর্তির সামনে সুন্দর করে কাঁসার থালা ও মাটির পাত্রে থরে থরে নৈবেদ্য সাজানো হয়। মন্দিরের বারান্দায় হিন্দু ভক্তদের পাশাপাশি মুসলমান ভক্তরাও মানত করতে আসেন। মানত পূরণ হলে এক জোড়া পায়রা মন্দিরের বারান্দা থেকে উড়িয়ে দেয়া হয়। তাগিতে ইটের টুকরা বেঁধে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। মূল মন্দির সংলগ্ন স্থানে নাটমন্দির নামে একটি বৃহৎ মঞ্চমণ্ডপ নির্মাণ করা হয়েছিল যেখান হতে দেবীর মুখমণ্ডল দেখা যেত। এটি লক্ষ্মণ সেন বা মহারাজা প্রতাপাদিত্য কর্তৃক ত্রয়োদশ শতাব্দীতে নির্মাণ করা হয়েছিল। কিন্তু কারা এটি নির্মাণ করেছিল তা জানা যায়নি। ১৯৭১ সালের পর এটি ভেঙে পড়ে। সেই সুদৃশ্য, লম্বা-চওড়া বিরাট নাটমন্দিরের আজ কিছুমাত্র অবশিষ্ট নেই। এখন শুধুমাত্র স্তম্ভগুলি দেখা যায়। দু-একটা স্তম্ভ কয়েকশো বছরের নীরব সাক্ষী হয়ে ইটের পাঁজর বের করে দাঁড়িয়ে আছে কোনও রকমে। একদা মন্দিরের চারদিকে সুউচ্চ প্রাচীর ছিল। মূল মন্দিরটি বাদে আর সবকিছুই আজ কালের গর্ভে বিলীন। মন্দিরের নওবতখানাও এখন ভগ্নস্তূপ।
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর পরিদর্শন : বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিববর্ষ উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার এই ঐতিহাসিক যশোরেশ্বরী পীঠ কালী মন্দির পরিদর্শন করেছেন ২৭ মার্চ ২০২১। এ উপলক্ষে সরকারের তত্ত্বাবধানে মায়ের মন্দিরটি আবারও কিছুটা সুসজ্জিত করা হয়। ভারতের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই আগমন এবং ভক্তিপূর্ণ শ্রদ্ধাজ্ঞাপন বাংলাদেশে অবস্থিত যশোরেশ্বরী মাতার যশ ও খ্যাতি ফের উপমহাদেশেসহ বিশ্ব জানতে পারে। তিনিই নিজ হাতে মায়ের মাথায় সোনার মুকুট পরিয়ে যান। তাঁর আগমন কালে মন্দির ও প্রাচীর রঙ করে প্রাচীরের ভাঙা অংশ মেরামত করা হয়েছে। মন্দিরের প্রবেশদ্বারে প্রায় ২০০ বছরের পুরনো বটতলা অংশের গর্ত বন্ধ করে ইট-পাথরের মিশ্রণে দৃষ্টিনন্দন বিস্তৃত চাতাল গড়ে তোলা হয়েছে। যুগে যুগে কত ভক্ত, কত সাধক এই মন্দিরে পুজো দিয়ে আত্মতৃপ্ত হয়েছেন, তার সঠিক খবর নেই। তবে মধ্যযুগে বাঙালি বারোভূঁইয়াদের অন্যতম রাজা প্রতাপাদিত্য এই যশোরেশ্বরী মাতার একনিষ্ঠ ভক্ত ও পুজারী ছিলেন, তিনিই মায়ের মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। এর পূর্বে-পরে বিশেষ কোন রাষ্ট্র নায়কের শ্রদ্ধাজ্ঞাপন বিষয়ক তথ্য জানতে পারিনি।
লেখক : সাধারণ সম্পাদক, সাতক্ষীরা সিকান্দার একাডেমি।