বাংলাদেশের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রচিত হতে যাচ্ছে—যেখানে দেশের একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রীয় উচ্চপর্যায়ের দুই সাবেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে গণহত্যার অভিযোগ গঠিত হয়েছে। গত বছরের জুলাই-আগস্ট মাসে সংঘটিত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় ঘটে যাওয়া সহিংস অভিযানের তদন্ত শেষে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এই অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়েছে। এই পদক্ষেপ শুধু বিচারিক নয়, রাজনৈতিক ও নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও তাৎপর্যপূর্ণ।
প্রসিকিউশন দাবি করেছে, রাষ্ট্রীয় বাহিনীর মাধ্যমে পরিচালিত এই সহিংস অভিযান ছিল পূর্বপরিকল্পিত এবং সরাসরি নির্দেশিত। এতে প্রায় দেড় হাজার নিরস্ত্র মানুষ নিহত হন। যদি তদন্তে উত্থাপিত অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হয়, তাহলে এটি হবে বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ রাষ্ট্রীয় সহিংসতার দলিল, যেখানে একটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন রক্তাক্ত দমন-পীড়নের শিকার হয়।
অভিযুক্তদের মধ্যে শেখ হাসিনার নাম থাকা নিঃসন্দেহে জাতিকে নাড়িয়ে দিয়েছে। একজন দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকা রাজনীতিক এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ সামনে আসা নিছকই রাজনৈতিক ঘটনা নয়—এটি দেশজুড়ে বিচার ও জবাবদিহিতার প্রশ্নকে নতুনভাবে সামনে এনেছে। একইসাথে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশের প্রাক্তন মহাপরিদর্শককে অভিযুক্ত করা রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাঠামোর জবাবদিহিতা নিয়েও বড় প্রশ্ন তোলে।
এই বিচারপ্রক্রিয়া কতটা স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষভাবে পরিচালিত হবে, সেটিই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। একটি সাংবিধানিক, মানবিক ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য রাজনৈতিক পরিচয় নির্বিশেষে সব অপরাধীর বিচার নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। কোনো ব্যক্তির অবস্থান বা পরিচয় বিচার থেকে তাকে রক্ষা করতে পারে না—এই বার্তাই এখন দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
এই প্রেক্ষাপটে আমরা আশা করি, ট্রাইব্যুনাল তার কার্যক্রমে স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করবে। একই সঙ্গে এই বিচার যেন প্রতিশোধের হাতিয়ার না হয়ে, হয় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার একটি নজির—সেই প্রত্যাশাও আমাদের।
বিচারহীনতার দীর্ঘ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে এবার সময় এসেছে সত্য উন্মোচন ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার। এই মামলা সেই পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হয়ে উঠতে পারে—যদি তা হয় ন্যায়সঙ্গত, নিরপেক্ষ ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন।