একটা সময় ছিল, যখন সকালের আলো মানেই ছিল পাখির ডাক, শিশিরে ভেজা ঘাসের সুবাস, অথবা দিগন্তে মিশে থাকা কোনো নদীর ধূসর নীল রেখা। শহর তখনো গ্রাম ছুঁয়ে ছিল, আর গ্রাম ছিল প্রকৃতির আত্মায় গাঁথা। তখন মানুষ গাছের ছায়ায় বসে গান গাইত, নদীর ধারে বসে কবিতা রচনা করত, কিংবা আকাশের তারা গুনে জীবন সাজাত। সেই জীবন এখন শুধু স্মৃতির ঘরে তালাবদ্ধ।
৫ জুন — বিশ্ব পরিবেশ দিবস। ক্যালেন্ডারের পাতায় যতটা নিরপেক্ষ, বাস্তবে ততটাই জরুরি এই দিনটি। একে কেবল একটি দিবস হিসেবে দেখলে ভুল হবে। এটি যেন প্রকৃতির হৃদয় থেকে আসা এক দীর্ঘ, বিষণ্ন কান্না।
প্রকৃতি প্রেমিকার মতো। চুপচাপ ভালোবাসে, অতল সহিষ্ণুতা নিয়ে মানুষের সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেয়। কিন্তু মানুষ? সে শুধু নিয়ে গেছে। গাছ কেটেছে, নদী ভরাট করেছে, পাহাড় কেটে ঘর বানিয়েছে। সে চায়নি এই প্রেমের কোনো দায় নিতে।
একসময় যে বাতাস নিঃশ্বাসে শান্তি দিত, আজ তা বিষ। যে বৃষ্টি ছিল ভালোবাসার মতো কোমল, এখন সে আশঙ্কার বার্তা হয়ে নামে। বন উজাড়, গ্লোবাল ওয়ার্মিং, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি—সবকিছু মিলিয়ে পৃথিবী যেন জ্বরগ্রস্ত।
আমরা বুঝি, কিন্তু বুঝেও না বোঝার ভান করি। যেভাবে সম্পর্ক ভেঙে গেলেও কেউ কেউ সেই সম্পর্কের মৃতদেহ টেনে বাঁচিয়ে রাখে, আমরা যেন তেমন করেই প্রকৃতিকে তার মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছি—একটি প্রাচীন প্রেমের দাফন ঘটিয়ে দিচ্ছি আমাদের চোখের সামনেই।
আজকের মানুষ চাঁদে চলে যায়, মঙ্গল গ্রহে পা রাখে। অথচ নিজস্ব পৃথিবীকে রক্ষা করতে পারে না। শহরে বেড়ে ওঠা শিশুরা গাছ চেনে না, পাখির ডাক শুনে না, কিংবা কোনো নদীর সঙ্গে গোপনে কথা বলতে শেখে না। এমন এক সময় এসেছে, যখন মানুষকে বলে দিতে হয়—‘গাছ লাগাও’, ‘প্রকৃতি রক্ষা করো’। যেন ভালোবাসাও এখন স্লোগানে পরিণত হয়েছে।
আমাদের শিক্ষায়, উন্নয়নে, সভ্যতায় যদি সবুজের কোনো স্থান না থাকে, তবে সে উন্নয়ন কেবল ধ্বংসের আরেক নাম।
আমরা কি সত্যিই প্রকৃতিকে ভালোবাসি? নাকি কেবল ভালোবাসার অভিনয় করি?
আজকের দিনটা হোক আত্মজিজ্ঞাসার। একটি গাছ লাগানো হোক প্রতিশ্রুতির প্রথম ধাপ। কিন্তু শুধু গাছ লাগালেই হবে না, প্রয়োজন গাছের প্রতি মমতা, নদীর প্রতি ভালোবাসা, বাতাসের প্রতি কৃতজ্ঞতা।
প্রত্যেকটি মানুষ যদি নিজেকে প্রকৃতির বন্ধু ভাবে, তবে হয়তো আবার শোনা যাবে ঝরনার গান, বনভূমিতে ফিরবে হরিণের দৌড়, এবং আকাশে উড়বে সেই চেনা পাখি, যাকে এখন আর দেখা যায় না।
প্রকৃতি আজ প্রার্থনা করছে। তার কণ্ঠস্বর হয়তো শুনতে পাচ্ছি না, কিন্তু অনুভব করলে বোঝা যায়—সে ডাকছে।
আসুন, আজকের দিনে আমরা শুধু সচেতন হই না, সাহসীও হই। অরণ্য বাঁচানোকে আন্দোলন নয়, ভালোবাসার ধর্ম মনে করি। নদীকে দেখি কেবল জল নয়, এক প্রাণসত্তা হিসেবে। পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণ যেন আমাদের চোখে হয় আত্মীয়, আমাদের হৃদয়ে হয় আশ্রিত।
তাহলেই একদিন এই দুনিয়া আবার ফিরে পাবে তার হারিয়ে যাওয়া সবুজ শাড়ি, আকাশ আবার নীল হবে, বাতাস হবে নির্মল, আর মানুষ প্রকৃতির কোলে ফিরে গিয়ে বলবে—”আমরা ফিরে এসেছি, মা!”
মোবাইল – ০১৬২০৭৬৬৭৮২