সবুজের পাল, হাওরের জিহ্বায়
আমি জলবন্দি, ভাষাহীন এক যাত্রী
ভাসছি সময়ের ত্রিমাত্রিক স্বপ্নে—
আলো নয়, ছায়ায় মুখর
আমার নিঃশব্দ প্রেম
গ্রামছেঁড়া,
পৃথিবীর পরিত্যক্ত মানচিত্রে
এ এক ক্ষণজন্মা চেতনার ঢেউ—
আশ্রয় কেবল
ভেসে থাকা ও বিকেলভাজা বিস্মরণ
যেখানে ডুব মানে
শাপলা-ঢেউয়ের ঘর,
আর স্মৃতিরা কবিতা—
পানকৌড়ির গলায় গাঁথা দুর্বিনের গান…।
“জলবন্দি প্রার্থনা” — মুহাম্মদ হাবীবুল্লাহ হেলালী রচিত এই কবিতাটি এক ধরণের গভীর বেদনার এবং স্মৃতি-স্নিগ্ধ চিত্রকল্পের বাহন। এটি মূলত একজন আত্মিক যাত্রীর অনুভবকে তুলে ধরে, যে হাওরের জলরাশিতে বন্দি হয়ে পড়েছে — সময়, স্মৃতি ও নিঃসঙ্গতার ঘূর্ণাবর্তে।
“সবুজের পাল, হাওরের জিহ্বায়” — এখানে প্রকৃতি যেন জীবন্ত, তারও একটি “জিহ্বা” আছে। ‘সবুজের পাল’ দ্বারা বোঝায় প্রকৃতির নৌকা বা চলমানতা, যা হাওরের জলধারায় প্রবাহমান।
“আমি জলবন্দি, ভাষাহীন এক যাত্রী” — কবি নিজেকে এক বন্দি যাত্রী হিসেবে দেখছেন, যে জলেই আটকে আছে, আবার নিজের অনুভবও প্রকাশ করতে পারছে না। এটি আত্মিক নিঃসঙ্গতা ও বাস্তব সংকটের ইঙ্গিত।
“আলো নয়, ছায়ায় মুখর / আমার নিঃশব্দ প্রেম” — প্রেম এখানে অন্ধকারে উদ্ভাসিত, ছায়ার মধ্যে তার গোপন ভাষা। শব্দহীন অথচ প্রবলভাবে অনুভূত।
“গ্রামছেঁড়া, / পৃথিবীর পরিত্যক্ত মানচিত্রে” — কবির নিজস্ব অস্তিত্ব যেন পৃথিবীর মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন; গ্রাম ও বিশ্ব মানচিত্র থেকে নির্বাসিত এক সত্তা।
“এ এক ক্ষণজন্মা চেতনার ঢেউ—” — এক অস্থায়ী, ভাসমান চেতনার অনুভব— যা কখনোই স্থায়ী হয় না, যেন একটি ঢেউয়ের মতো এসে মিলিয়ে যায়।
“আশ্রয় কেবল / ভেসে থাকা ও বিকেলভাজা বিস্মরণ” — এখানে জীবন মানে শুধু বয়ে চলা আর বিস্মৃতির মধ্যে ডুবে থাকা। ‘বিকেলভাজা’ শব্দটি অসাধারণ—দুপুরের শেষ ভাগের বিষণ্ণ আলো, যা স্মৃতির সঙ্গে মিশে এক ধরনের হারিয়ে যাওয়ার অনুভব দেয়।
শেষ চরণগুলো:
“যেখানে ডুব মানে / শাপলা-ঢেউয়ের ঘর,” — ডুবে যাওয়াও যেন এক প্রাকৃতিক আবাস, শাপলার ফুল ও ঢেউয়ে গড়া।
“আর স্মৃতিরা কবিতা— / পানকৌড়ির গলায় গাঁথা দুর্বিনের গান…” — স্মৃতি হয়ে ওঠে কবিতা, এবং সেই কবিতা যেন এক দুর্বোধ্য গান—যা শুধু পানকৌড়ির মতো জলে ডুবসাঁতার জানা প্রাণীই ধারণ করতে পারে।
“জলবন্দি প্রার্থনা” একটি বিমূর্ত ও চিত্রাত্মক কবিতা যা জলে, স্মৃতিতে ও নিঃশব্দতায় বন্দি এক আত্মার অনুরণন। এটি শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্য নয়, বরং একাকীত্ব, বিচ্ছিন্নতা, বিস্মরণ এবং প্রেমের নিঃশব্দ ভাষাকে রূপ দেয়।