• আজ- সোমবার, ১৪ জুলাই ২০২৫, ০৯:৫৪ অপরাহ্ন

গ্রামের ধুলোপথে হারিয়ে যাওয়া চাকার ছন্দ: ঘোড়া ও গরুর গাড়ির অন্তিম গান

লেখক : / ৮৪ বার দেখা হয়েছে
আপডেট : মঙ্গলবার, ১০ জুন, ২০২৫
কৃষিকাজে, হাটে যাতায়াতে, কিংবা সংসারের নিত্য চাহিদা মেটাতে নির্ভরযোগ্য বাহন।

add 1

এবিএম কাইয়ুম রাজ, সাতক্ষীরা

এক সময়ের গ্রামীণ জীবনের অপরিহার্য সঙ্গী—ঘোড়া ও গরুর গাড়ি—আজ শুধুই অতীতের এক ধূসর স্মৃতি। গাঁয়ের মেঠোপথে কাদামাটি ছড়িয়ে ছুটে চলা এই বাহনগুলো ছিল না শুধু পরিবহনের মাধ্যম, ছিল মানুষের আবেগ, সংস্কৃতি আর জীবিকার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়ানো।

যে পথে একসময় ঢুলুঢুলু চোখে গরুর গাড়ি টানত গ্রামের কৃষক, আর ঘোড়ার ছন্দময় পদচারণায় কনে পৌঁছে যেত শ্বশুরবাড়ি, সেই পথ আজ নিঃসাড়। ইঞ্জিনচালিত বাহনের গর্জনে থেমে গেছে বেলগাড়ির বেল আর গাড়িয়ালের সুরেলা ডাক।

মাত্র কুড়ি বছর আগেও কোনো বিয়েবাড়ি, মেলা বা উৎসব মানেই ছিল ঘোড়ার গাড়ির শোভাযাত্রা। সে এক রাজকীয় অনুভব! ঘোড়ার গাড়ি মানেই সম্মান, অহংকার, আর সামাজিক মর্যাদার প্রতীক। গরুর গাড়ি ছিল কর্মজীবী মানুষের সহচর—কৃষিকাজে, হাটে যাতায়াতে, কিংবা সংসারের নিত্য চাহিদা মেটাতে নির্ভরযোগ্য বাহন।

কাশিমাড়ীর প্রবীণ ব্যবসায়ী সবুর মোল্লা nostalgically বললেন, “একসময় এই গ্রামে এমন পরিবার ছিল না যার নিজস্ব গরুর গাড়ি ছিল না। অনেকে আবার ভাড়ায় চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করত।”

আজ এই চিত্র যেন কেবল ছবির ফ্রেমে বন্দি। প্রযুক্তির প্রবল ঢেউয়ে হারিয়ে যাচ্ছে সময়ের সাক্ষ্য হয়ে থাকা এই বাহনগুলো। মাইক্রোবাস, নছিমন, ইজিবাইক, পিকআপ—নতুন নতুন বাহন এসে দখল করে নিয়েছে সেসব সড়ক, যেগুলো একসময় ছিল গরু আর ঘোড়ার অবাধ পথ।

আটুলিয়ার ঘোড়ার গাড়ি চালক সাদেক আলী স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বললেন, “বউকে আনতে ঘোড়ার গাড়ি ছিল আমার একমাত্র বাহন। সেই গাড়ি যেমন আর নেই, তেমনি হারিয়ে গেছে সেই সময়ও।”

তবে কিছু মানুষ এখনো আঁকড়ে ধরে রেখেছেন এই ঐতিহ্য। কালীগঞ্জের শহিদ মিয়া এখনও একটি ঘোড়ার গাড়ি সংরক্ষণ করেছেন। তিনি বলেন, “কম খরচে মালামাল বহনের জন্য শহরেও অনেকে এটা ব্যবহার করতে পারেন, যদি সুযোগ দেওয়া হয়।”

কিন্তু বেশিরভাগই যেমন মাহতাবের মতো সাবেক গাড়িয়ালরা বাধ্য হয়ে বদলেছেন পেশা। তিনি বললেন, “ঘোড়ার গাড়ি চালিয়ে একসময় সংসার চলত। এখন সে দিন আর নেই।”

ইউনিয়ন সদস্য বাবলুর কণ্ঠে হতাশা—“নতুন প্রজন্ম ঘোড়ার গাড়ি দেখেইনি। তাদের এসব দেখাতে হলে এখন জাদুঘরে নিয়ে যেতে হবে।”

এক সময় চারণকবির মুখে মুখে ফিরত—
“ওকি গাড়িয়াল ভাই, কত রব আমি পন্থের দিকে চাইয়া রে…”
আজ সে গানও যেন সময়ের গহ্বরে নিঃশব্দে বিলীন।

এই দেশীয়, পরিবেশবান্ধব বাহনগুলো শুধু যানবাহন নয়, আমাদের শেকড়, আমাদের সাংস্কৃতিক পরিচয়। সেই শিকড় উপড়ে গেলে শুধু অতীত নয়, ভবিষ্যৎও হারিয়ে ফেলে আপন পরিচয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ঐতিহ্য বাঁচাতে চাই সরকারের সদিচ্ছা, সমাজের উদ্যোগ, এবং নতুন প্রজন্মের জানার আগ্রহ। না হলে, হয়তো কোনো একদিন, গল্পের বইয়ের পাতায় কিংবা জাদুঘরের কাচঘেরা জানালায়ই শেষবার দেখা যাবে সেই ধীরগতির, কিন্তু অন্তরে গাঁথা সেই গাড়ির ছায়া।

গ্রামের পথ ধরে যে চাকা একদিন ঘুরত ইতিহাসের ছন্দে, আজ তা থেমে গেছে—চিরতরে।

add 1


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

অন্যান্য লেখা সমূহ